চলে গেলেন আরেক ‘গরিবের বন্ধু’ ডা. হাসান মুরাদ

অনলাইন ডেস্ক •


কোভিড পরীক্ষা নিয়ে যখন হিমশিম, তখনই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ল্যাবে যোগ দেন ডা. হাসান মুরাদ। সঠিক সময়ে নমুনার ফল পৌঁছে দিতে পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিন-রাত কাটিয়েছেন ল্যাবেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ভাইরাসেই আক্রান্ত হোন ‘গরিবের বন্ধু’ খ্যাত এ চিকিৎসক। দীর্ঘ দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে প্রাণঘাতী ভাইরাসের সাথে পাঞ্জা লড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। গতকাল সোমবার ভোর রাত সাড়ে চারটার দিকে নগরীর বেসরকারি এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় ৪৬ বছর বয়সী এ চিকিৎসকের।

ডা. হাসান মুরাদ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি চমেকে অবস্থিত আরটি-পিসিআর ল্যাবেও (করোনা পরীক্ষাগার) কর্মরত ছিলেন। সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাওলা পাড়ার নুরু মাস্টার বাড়ির মৃত আবদুল মোনাফের ছেলে মুরাদ চমেকের এমবিবিএস ৩৫তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৬ ডিসেম্বর ডা. হাসান মুরাদ ও তার স্ত্রী কোভিড আক্রান্ত হয়ে নগরীর বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তি হন। সপ্তাহখানেক চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে স্ত্রী বাড়ি ফিরলেও অবস্থার অবনতি হয় ডা. মুরাদের। এরপরই কেবিন থেকে স্থানান্তর করা হয় আইসিইউতে।

পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডা. এ টি এম রেজাউল করিম বলেন, ‘আক্রান্তের পর থেকে মুরাদের অক্সিজেন লেভেল ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একপর্যায়ে তার ফুসফুসে আক্রান্তের পাশাপাশি কোভিডের জীবাণু মস্তিস্কে আঘাত হানে। যাকে ‘এনক্যাফালাইটিস’ বলা হয়। দুই দিন লাইফ সাপোর্টেও রাখা হয়েছিল। অক্সিজেনের পাশাপাশি হাই-ফ্লো ন্যাজেল ক্যানুলাও সার্বক্ষণিক দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।’

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়াতে হলেও তিনি পরিবার নিয়ে নগরীর নবাব সিরাজদ্দৌলা রোডের ভূঁইয়া হেরিটাইজ নামক একটি ভবনে বসবাস করতেন। তাঁর তাফিদা হাসান (৭) ও মো. তাহফিস হাসান (৪) নামে ২ শিশু সন্তান রয়েছে। দম্পতি ছাড়াও ডা. মুরাদের বৃদ্ধ মাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। তবে স্ত্রী ও মা এখন সুস্থ।

চমেক হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও আরটি পিসিআর ল্যাবের প্রধান ডা. এহসানুল হক কাজল পূর্বকোণকে বলেন, ‘ল্যাব শুরুর পর কিছুদিন এখানেই কর্মরত ছিল। পরে অন্যত্র চলে গেলেও সর্বশেষ মাস দু’য়েক আগে আবার ফিরে আসেন। আন্তরিকতার সাথেই কাজ করতেন। কিন্তু এভাবে চলে যাবেন ভাবতেও পারিনি।’

সাতকানিয়ার ‘গরিবের বন্ধু’ খ্যাত ডা. হাসান মুরাদ : চট্টগ্রামের মানবিক ডাক্তার সমিরুল ইসলামের পর সাতকানিয়ার ‘গরিবের বন্ধু’ হিসেবে খ্যাতি ছিল ডা. হাসান মুরাদের। সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন অসহায় ও দুস্থদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে গরিবের বন্ধু হিসেবে খ্যাতি পান তিনি।

এমন গরিবের বন্ধুর মৃত্যুতে সাতকানিয়ার বিস্তৃত জনপদে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র বিরাজ করছে শোকের আবহ। চমেকের প্যাথলজি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জিল্লুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন- ‘হাসান মুরাদ আমার সহকর্মী হিসেবে প্যাথলজির লেকচরার ছিল। পরে মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে আসে। সবসময় হাসি মুখ দেখেছি। এমনকি সংকটময় পরিস্থিতিতেও হাসি ছিল অম্লান। আজ হাসান মুরাদ চিরনিদ্রায় শায়িত। হাসান মুরাদদের মতো মানুষ আমাদের খুব দরকার ছিল।’

সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য বিভাগের বর্তমান সহকারী পরিচালক ডা. মেজবাহ উদ্দীন বলেন, ‘ভালো ব্যবহার ও ভদ্র স্বভাবের ডা. হাসান মুরাদ ছিলেন সাতকানিয়ার প্রিয়মুখ ও গরিবের বন্ধু। কোন জাত ভেদাভেদ না রেখে চিকিৎসা দিতেন তিনি। এছাড়া সাতকানিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে তাঁরও অগ্রণী ভূমিকা ছিল।’